পাস্ট লাইভস- লাভ ট্রায়েঙ্গেলের রুপকে ব্যক্তির আইডেন্টিটির পর্যবেক্ষণ




"কোরিয়ানে একটা শব্দ আছে, 'ইন ইয়ুং'। যার অর্থ ভাগ্য, বা নিয়তি। কিন্তু এর আসল অর্থ হচ্ছে একজন মানুষের সাথে আরেক মানুষের সম্পর্ক। খুব সম্ভবত শব্দটি এসেছে বুদ্ধিজম আর পুনর্জীবন থেকে। যদি দুটো মানুষের কাপড় রাস্তায় ঘষাও লাগে, এর অর্থ তাদের মধ্যে নিশ্চিত গত জীবনে কোনো না কোনো সম্পর্ক ছিল। আর যদি দুজনের বিয়ে হয়, এর অর্থ তাদের মধ্যে আট হাজার লেয়ারের ইন ইয়ুং বিদ্যমান।" 


পূর্ব এশিয় সব সিনেমারই টুকরো উপস্থিতি 'পাস্ট লাইভস' এর মধ্যে বিদ্যমান। পূর্ব এশিয় আর্টহাউজ ফিল্মের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য ধীর লয় এই সিনেমাতেও উপস্থিত, তবে এই ধীরতাই যেন বারবার চরিত্রদের বিচ্ছিন্নতা স্বরণ করিয়ে দেয়। এর গণ্ডি কেবল কজন ইমিগ্র‍্যান্টদের আমেরিকায় এসে বিদেশে জীবনের হাহাকার, নিষিদ্ধ সম্পর্ক কিংবা চরিত্রদের নিঃসঙ্গতাতেই সীমাবদ্ধ না, এর ব্যপ্তি সিয়োল থেকে টরোন্টো; কোরিয়া থেকে নিউ ইয়র্কে; এই জীবন থেকে পূর্ববর্তী জীবনে, ব্যক্তি এবং তার সাংস্কৃতিক আত্নপরিচয়ে। 

স্পয়লার এলার্ট - কাহিনী বিশ্লেষণ 

কেন্দ্রীয় চরিত্র নোরা যদিও কোরিয়া ছাড়ে সিনেমার শুরুতেই, কিন্তু কোরিয়া ছেড়ে যায় না তাকে কখনোই। তার নাম বদলে যায়, দক্ষিণ এশিয় নাম বদলে তার ইংরেজি নাম রেখে সাংস্কৃতিক মূলোৎপাটনের সর্বাত্নক চেষ্টা হয়। কিন্তু তার মধ্যে কোরিয়ান পরিচয়টা সুপ্ত অবস্থাতে বেড়ে উঠেই। তার মনের গহীনে রয়ে যায় কোরিয়ান সেই বন্ধুটা, যে তার সাথে একবার ডেটে গিয়েছিল। যেই ডেট ছিল মুনের মায়ের দেওয়া উপহার, দেশ ছাড়ার আগে এক টুকরো কোরিয়ান স্মৃতি। সিনেমায় দেখা যায় এক অভিবাসী বাচ্চা মেয়ের সম্পূর্ণ নতুন দেশে নতুন মানুষদের সাথে বিচ্ছিন্নতা, তাদের মাঝে তার নিঃসঙ্গতা। আমেরিকান ড্রিমের তিক্ততা একটু একটু করে ফুটে উঠতে থাকে মুনের বিষাদে। ওইদিকে বারো বছর তাকে আমরা আর দেখতে পাই না, ডিরেক্টর সেলিন সং তার এই বারো বছরের যাত্রা আমাদের কাছে গোপন করেই রাখে, যার পরাকাষ্ঠা আমাদের দেখানো হয়। 


                         

বারো বছর পর হঠাৎ একদিন নোরা তার কোরিয়ান সেই বন্ধুকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, এবং আবিষ্কার করে তার বন্ধুটিও তাকে খুঁজে চলেছে এত এত বছর ধরে। তারা কথা বলে, আর বলতে বলতেই মুন একটু একটু করে কোরিয়ান পরিচয়ের সংস্পর্শে আসে, নতুন করে সে কোরিয়ান লিখতে শিখে। নোরা দুই জীবন সামলায়, একদিকে নিউ ইয়র্কে, আরেকদিকে সিউলে। তার শারীরিক উপস্থিতি নিউ ইয়র্কে হলেও মন পড়ে থাকে সিউলে। তার শিকড়ের সংস্পর্শে এসে আমেরিকান ড্রিমের কথা, নোবেল-পুলিৎজার জেতার স্বপ্নের কথা, তার প্লেরাইট হিসেবে চাকরির কথা ভুলে যায় সে। ওইদিকে ছেলেটি, হে সুং, আর নোরার জীবন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে দেখতে পাই কোরিয়ান আর আমেরিকান জীবনে কত পার্থক্য। হে সুং থাকে তার পরিবারের সাথে, এখনো পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে মাঝারি মানের চাকরিকে উদ্দেশ্য করে। ওইদিকে নোরা স্বাধীন, সে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে এখন একা থাকে, তার স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষাকে অনুসরণ করে। কোরিয়ান আর আমেরিকান জীবনে দোদুল ঝোলাতে সে কোনোটাতেই স্থির থাকতে পারে না। তার আকাঙ্ক্ষার কথা বাদ দিয়ে সে সিউলের টিকেট খোঁজে। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় কথা আপাতত বন্ধ করে দেয়ার। তার দুই দুই বার দেশান্তরের ফল সে বৃথা হতে দিবে না। তার কোরিয়ান আইডেন্টিটির সাথে এভাবেই তার বিচ্ছেদ ঘটে। তাদের আর কথা হয় না। 


     হে সুং, নোরা এবং নোরার স্বামী আর্থার

 এদিকে আমেরিকান ককেশিয়ান এক লেখকের সাথে তার বিয়ে হয়। কিন্তু হে সুং এর সাথে নোরার সম্পর্ক যতটা জোড়ালো, আমেরিকান এই সাদা পুরুষের সাথে সুখী হলেও কেমন যেন তেমনই ম্লান, অতিসাধারণ। তাইতো আবার বারো বছর পর হে সুং এর নিউ ইয়র্কে আগমনকে উপলক্ষ করে আমেরিকান সাদা পুরুষের প্রতীকে আমেরিকান আইডেন্টিটি বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে নোরার শিকড়ের পরিচয়ের সামনে। কিন্তু নোরার কাছে তার সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কাছে যে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা হার মানবে না, তা আর্থার খুব ভালো করেই জানে। 

তবু হে সুং যখন আমেরিকা আসে, নোরা দেখা করে তার সাথে যখন, সে যেন তার কোরিয়ান স্বত্ত্বার সংস্পর্শে আসে নতুন করে। হে সুং আমেরিকা এসে পৌছলে সিনেমায় দেখা যায় তার ছায়াকে নিউ ইয়র্কের উচু দালান আর বৃষ্টি দ্বারা আবৃত হতে। মেট্রোপলিটন এই শহরে তাকে জড়িয়ে ধরে সেই একই একাকীত্ব, যা নোরাকে ভুগিয়েছে সে প্রথম যখন কানাডা আসে তখন। অথচ হে সুং আর নোরার যেদিন দেখা হয়, বৃষ্টিকে প্রতিস্থাপন করে ঝলমলে সূর্য। আবহাওয়া যেন তাদের মনেরই অবস্থা। তারা ঘুরে দেখে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি আর এমন সব জায়গা, যেখানে নোরা তার স্বামীর সাথেও যায় নি কখনো। তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায় এমন এক 'ইন-ইয়ুং', যা হয়তো হাজার হাজার বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠছে তাদের মধ্যে, যেখানে হয়তো তার আমেরিকান স্বত্ত্বা কখনোই পৌছতে পারবে না। 


   হে সুং কে ঘিরে আছে ধূসর নিঃসঙ্গতা 

তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা সেলিন সং এর হাত থেকে 'লাভ ট্রায়েঙ্গেলের' রুপকের মাধ্যমে উন্মোচিত হলো অভিবাসী এক মেয়ের তার শিকড়ের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশের গল্প। সিনেমাটি এবছর সান্ডেস ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়েছে। বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, সিনেমাটি কোরিয়ান-কানাডিয়ান ডিরেক্টর সেলিন সং এর প্রথম সিনেমা, এবং তিনি নিজেও পূর্বে নাট্যকার হিসেবে কাজ করেছেন। তবে কি সিনেমাটি নিও রিয়েলিস্টিক? অর্থাৎ, সেলিন সং এর নিজের জীবনের সম্প্রসারিত গল্পই বললেন সিনেমার মাধ্যমে অভিবাসী এই উচ্চাকাঙ্খী নারী? 

সাংস্কৃতিক পরিচয়ের গুরুত্ব অনুধাবনে পাস্ট লাইভস যেন ঝুম্পা লাহিড়ীর দ্যা নেমসেকের চেয়েও সফল। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবারণ করতে স্বদেশ ছেড়ে, নিজ মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সাংস্কৃতিক নতুন পরিচয়ের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? নিজের দেশের যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন, একজন কি কখনোই হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠা 'ইন ইয়ুং' এত সহজেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে, আর সম্পূর্ণ নতুন এক জাতিস্বত্বার সাথে আঁতাত জমাতে পারে? এমনই সব গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা রয়ে যায় 'পাস্ট লাইভস' সিনেমার এন্ড ক্রেডিট রোল চলাকালীন, যেই প্রশ্নের উত্তর দর্শককে খুঁজে বের করতে হয় বহুদিন ভেবে ভেবে

Comments